তামান্না হক রীতি

গত ২০ নভেম্বর জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরের ৩৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। মূলত এ সনদের মাধ্যমেই শিশুদের অধিকার যে মানবাধিকার– তা প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অনুমোদিত এ সনদে এখন পর্যন্ত ১৯৬টি রাষ্ট্র পক্ষভুক্ত। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এ সনদে অনুস্বাক্ষর করে। তবে শিশু অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার আরও পুরোনো।

শিশু অধিকার সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার বহু আগেই বাংলাদেশ সংবিধান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশে শিশু আইন ১৯৭৩ প্রণীত হয়েছে। এর পর বিভিন্ন সময়ে শিশুদের অধিকার উন্নয়নে বেশ কিছু আইনি ও নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিশুশিক্ষা ও শিশুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে বাংলাদেশের সাফল্য বহির্বিশ্বে প্রশংসিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনও শিশু অধিকার রক্ষায় অনেক পিছিয়ে। বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ এবং সর্বক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না পারায় এখনও আমাদের শিশুরা তাদের পূর্ণ অধিকার ভোগ করতে পারছে না। বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা আরও বেশি পিছিয়ে পড়ছে। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে একটি শিশুকেও বাদ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে হবে।

একটি শিশুর পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যথাযথ বুদ্ধিবৃত্তিক, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে শিশুর অধিকার রয়েছে তার সুষ্ঠু বিকাশে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ ও অবকাঠামো পাওয়ার। আমরা কি আমাদের শিশুদের জন্য তা নিশ্চিত করতে পারছি? দেশের বিদ্যমান শিশু অধিকার পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করলে এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই পাওয়া যায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ১১ মাসে ৪৫৬ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে; ৯৭৮ শিশু নির্যাতনের শিকার; ২৯৬ শিশু ধর্ষণের শিকার; ৬৯ ছেলেশিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। উচ্চ আদালত শিক্ষাঙ্গনে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করলেও এ সময়ে শিক্ষকের নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৩৯ শিশু। এ ছাড়া উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ৫৭ শিশু এবং শিক্ষক দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ২৮ শিশু। জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২ অনুযায়ী গত ১০ বছরে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৭৭ হাজার। তবে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের সংখ্যা কমেছে। স্পষ্টত বাংলাদেশ শিশুশ্রম নিরসনের বৈশ্বিক লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে হবে– তা অর্জনে অনেক পিছিয়ে।

অন্যদিকে, শিক্ষা একজন শিশুর বিকাশে, তাকে একজন আত্মমর্যাদাপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলভিত্তিক, কোচিংনির্ভর শিক্ষা তথা অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্তি দিতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা শিশুদের ওপরেও বেশ প্রভাব ফেলছে।

এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের শিশুদের শারীরিক ও মনোসামাজিক বিকাশ কতটা হচ্ছে? শিশুদের খেলার মাঠ, বিনোদনের ব্যবস্থা কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ ক্রমশ সীমিত হয়ে আসছে। আধুনিকতা ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে শিশুদের মনোজগতে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে, তার ওপর আলোকপাত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় উদ্বেগ হচ্ছে যত্রতত্র ফাস্টফুডের ছড়াছড়ি, যা শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ‘স্লো পয়জনিং’ হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া ভেজাল বা রাসায়নিকযুক্ত খাবার তো রয়েছেই। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী, যতই আপনি সন্তানকে পুষ্টিকর খাবার প্রদানের চেষ্টা করুন, আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না– আদৌ তার শরীরে সে পুষ্টি যাচ্ছে, নাকি প্রবেশ করছে নানা ক্ষতিকর পদার্থ। এর ওপর বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। যে কোনো সংকটেই শিশুরা বেশি প্রভাবিত হয়। কেননা, তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় তখন আর খুব বেশি গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার পায় না। তাই শিশুদের প্রকৃত উন্নয়ন ও সুরক্ষা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন আনা ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের শিশুদের জন্য, শিশুদের নিয়ে ভাবতে হবে। পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তাদের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সর্বোত্তম স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পরিকল্পনা গ্রহণকালে তাদের মতামত বা অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশ ও বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র গভীর সংকটে পড়বে। কেননা, এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব।

তামান্না হক রীতি: সমন্বয়ক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)