লুৎফর রহমান
সরকার বদল হয়েছে। একসময় আন্দোলনই করা যেতো না, আর এখন আন্দোলনের হিড়িক পড়েছে। শিক্ষার্থীরা সচিবালয় ঘেরাও করে পরীক্ষা বাতিল করিয়েছে। হাতুড়ে ডাক্তাররা নেমেছে তাদেরও সার্টিফিকেট দিতে হবে। আনসারদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে ঢাকা শহর যেনো আন্দোলনের শহর হয়ে গেছে। তবে এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার এতোদিন যারা যুক্তি দিয়ে কথা বলেছে তারা একটা ভিত্তি রচনা করতে পারলেও পনেরো বছরের আওয়ামী দুঃশাসনকে হটাতে পারেনি, হটিয়েছে সেইসব ছাত্র-তরুণরা যারা আবেগ ও সাহস দেখাতে পেরেছে। বর্তমান সরকার চার সপ্তাহ অতিক্রম করলেও তার স্থিতাবস্থা হয়নি। সে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো আয়ত্তে আনতে পারেনি বাস্তব কারণে। এরপর আছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈদেশিক সম্পর্ক সংক্রান্ত সংকট। এর মধ্যে যারা চর দখলের সুযোগ নিচ্ছেন তারা হয়তো ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছেন। যে সরকার গণতন্ত্রায়নের জন্য নানাবিধ সংস্কারের অঙ্গীকার করেছে তার জন্য স্থিতাবস্থা আবশ্যক।
অস্থিতিশীলতা পতিত স্বৈরাচারের পক্ষে যায়, যা দেশের মানুষ মোটেই কামনা করে না। মানুষ বোঝে এই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীরা কারা এবং তাদের গন্তব্য কোথায়? বর্তমান সরকারের সক্ষমতা ও মেয়াদকাল প্রশ্নে দেখতে হবে সরকারটির অবয়ব ও কর্মদক্ষতার বিষয়টি। তারপর আসে মেয়াদকালের বিষয়টি। সরকারে অনেক স্বনামখ্যাত এনজিও মুখ দেখা যাচ্ছে। মানুষ তাদের প্রতি তখনই খুশি হবে যখন দেখবে তারা কামিয়াব হয়েছেন। কেতাবি মানুষ আর বাস্তবতার মাঝে ফারাক থাকে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে তারা সফল হোন এটাই মানুষের দাবি।
প্রধান উপদেষ্টা মানুষকে আহ্বান করেছেন ধৈর্য ধরতে। সে বিষয়টি যেমন গুরুত্বের সাথে নিতে হবে, তেমনি একটি রোডম্যাপ অনুসারে কাজটিও শুরু করতে হবে। সরকারকে একটা জবাবদিহির ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তাদের মানুষের পক্ষে থেকে বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র প্রভৃতি সাজাতে হবে নতুন করে এবং অর্থনীতিকে সচল করতে হবে। এখানে রাজনীতির লোক না থাকলেও কাজটা রাজনীতিরই। তারা নির্বাচিত নন, তো ছাত্রজনতার মেন্ডেটপ্রাপ্ত সরকার। তাদের জবাবদিহি তাই জনগণের কাছে। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের তা ছিলো না। এখানেই এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য। বর্তমান সরকার জনগণের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করবে, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর নয়। জনগণকে বলা হচ্ছে ধৈর্য ধর, আর জনতার বক্তব্য হচ্ছে যেনো এই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে না যায়! এখানে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও দলগত সুযোগ নেয়ারও চেষ্টা আছে। সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি থেকে উদ্বেগও আছে। আসলে সম্প্রদায়ের লোকেরা আশাবাদী থাকলেও কোনো অর্জন দেখছে না। প্রত্যাশার সাথে মিলিয়ে কোনোকিছুকে সাজানো যাচ্ছে না। কারণ সরকারের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারকে প্রথমটায় সুস্থির হতে হবে এবং সাথে সাথে একটা কাজের পরিকল্পনা পেশ করে এগুতে হবে। এক্ষেত্রে তারা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনীতিকদের সাথে মতবিনিময় করবেন।
সরকারকে সব পরিবেশে গণতান্ত্রিক মানসিকতা দেখাতে হবে। তাদের সংবেদনশীল হতে হবে। দেশে অর্থনৈতিক সংকট প্রচণ্ড। সালমান এফ রহমান বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এস আলম গ্রুপ ইসলামি ব্যাংক থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এটা শুধু ব্যাংক লুটপাট নয়, হয়ে গেছে ব্যাংক ব্যবস্থা লুটপাট, যা সচরাচর কোথাও ঘটে না। বাংলাদেশে ব্যাংকিং সিস্টেমটাকে দেউলিয়া করে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের কাঠামোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এরা এ কাজ নিজেদের মালিকানায় থাকা ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকগুলোতে করেছে। ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে দিয়েছে। তারপর টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও নিয়েছে। এটা হয়েছে একটা দুষ্ট চক্রাকারে যেমন- প্রাইভেট ব্যাংক থেকে সরকারি ব্যাংক এবং শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।
জনগণের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে এই টাকা উদ্ধার হোক। টাকা আসলে অলৌকিক বিষয়, কাগজের নোট। এর পৃষ্ঠে বাস্তব সম্পদ পাওয়া গেলে উদ্ধারে কাজে লাগবে। তবে সেটা কমই পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। আর টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেলে বিষয়টা আরো জটিল হয়ে যায়। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বিগত সময়ে বিদেশে পাচারকৃত টাকা উদ্ধার হয়েছিলো কম করে হলেও। এক্ষেত্রে ব্যাংক বিষয়ে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে। বর্তমান সরকার সে কাজ করবেন। এ ব্যাপারে একটি শ্বেতপত্র আবশ্যক যা সরকারকে সাহায্য করবে। সব মানুষের দাবি এসব অপরাধীকে ধরে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। না হয় শহিদদের আত্মদান বিফলে যাবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে চালু করতে হলে পুঁজি সরবরাহ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন আর টাকা ছাপাবেন না। এতে মুদ্রাস্ফীতি আরো বাড়বে। তাহলে নতুন শেয়ার ছেড়ে পুঁজি গঠন করতে হবে। তার আগে মালিকানা ঠিক করা বড় ব্যাপার। এসব ব্যাংকের মালিকদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে, অনেকে দুর্নীতির দায়ে বা ঋণখেলাপির কারণে মামলায় পড়েছে, অনেকেই হয়তো খুনের আসামি পড়বে। এখন ব্যাংকগুলোর নতুন ব্যবস্থাপনা পরিষদ ঠিক করতে হবে। এখানে কাদের বসানো হবে এটাও একটা বিষয়। অনেকের ধারণা এতে কি সুফল আসবে? কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের বিকল্প কোনো পথ নেই। এক্ষেত্রে একটা কমিশন গঠন করা যেতে পারে যারা ব্যবস্থাপকদের মনোনয়ন দেবে জাতীয় স্বার্থে। সরকারকে এখানে টানা যাবে না। তাহলে যারা সরকারে থাকবেন তাদেরই প্রভাব পড়বে ব্যবস্থাপকদের ওপর। এতে দলীয়করণ থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না। কাজগুলো খুবই কঠিন, তারপরও করতে হবে। শেখ হাসিনা সরকার ব্যাংকগুলোকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। অভিজ্ঞতা বলে জবাবদিহির বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের সব ধ্বংসকৃত প্রতিষ্ঠান যেমন- দুদক, নির্বাচন কমিশন, এনবিআর প্রভৃতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া নিরপেক্ষভাবে হতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে নিয়োগকৃতরা যাতে কারো প্রভাব বলয়ে না থাকে। কাজটা করবে একটা কমিশন। এ মর্মে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা হতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও প্রয়োজনীয় ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের নতুন এক গণমুখী রাষ্ট্রকাঠামোর মাঝে যেতে হবে। আমাদের সামনে দুটো কর্তব্য। একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা আর অন্যটি হচ্ছে একটি আধুনিক সংবিধান নিশ্চিত করা। সংবিধান প্রণয়নের সময় মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত মূলনীতি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র থেকে কোনোক্রমেই সরে আসা যাবে না। সংবিধানে এমন সব ধারা সংযোজন করতে হবে যাতে আর কর্তৃত্ববাদী শাসন জন্ম নিতে না পারে এবং গণতন্ত্র অব্যাহত থাকে। এতে মানুষের সব আশা পূরণ হওয়ার পথ খুলবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হবে জাতিকে এ ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছানো। সংবিধানটি প্রণয়ন করবেন অবশ্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সেজন্য প্রয়োজনীয় সময় নতুন সরকারকে দিতে হবে। তার মেয়াদকাল নিশ্চয় অধিক সময় হবে না।
হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক সরকার বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ে আঠারো লাখ ছত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝা রেখে গেছে। আজকে এর সমাধান আমাদেরই করতে হবে। তবে চোরদের ফৌজদারি আইনে শাস্তি দিতে হবে। তা নাহলে শহীদদের সঠিক মর্যাদা দেয়া হবে না। শাস্তি পেলে পরবর্তী অপরাধীরা অপরাধ করার সময় ভাববে। রাজনীতির সুযোগ নিয়ে যারা অর্থনীতিকে তছনছ করেছে তাদের শাস্তি প্রাপ্য হয়ে গেছে। এছাড়া সম্পদ উদ্ধারে আইনসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক ব্যাংকিং চালু করতে হবে। এটা বর্তমান সময়ের ব্যাংকিং। এছাড়া বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে জ্বালানি খাতের ওপর। স্বৈরাচারী শাসন আর্থিক খাতের সাথে জ্বালানি খাতকেও নষ্ট করে গেছে। আবার এ দুটো খাত একে অপরকে নষ্ট করেছে।
ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে লুটপাট হয়েছে। ফার্নেস ওয়েলের জায়গায় তারা কম দামের গ্যাস পেয়েছিলো এমন খবরও বের হচ্ছে। সবকিছু তলিয়ে দেখতে হবে। এ দুই খাতের ঘাটতি মেটানোর জন্য তদানিন্তন সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ খাতেও টান মেরেছে। অর্থাৎ সব তছনছ হয়েছে। দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র আবার কর ফাঁকি দিয়েছে। এরা জাতির চিহ্নিত দুষমন। এই অলিগাররা অর্থনীতির সব শাখাকে চুষে ছোবড়া করে দেয়।
একসময় রাজনীতিবিদরা অনুভব করেন তারা দেশ চালান না- চালায় অলিগাররা। আমাদের এবার দ্রুত এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই কাজটির দায়িত্ব পড়েছে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। তারা দ্রুত স্থিতাবস্থায় ফেরাবেন দেশকে। রাজনৈতিক দলগুলো ও সাধারণ মানুষ তাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত। এবার তারা রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়ে কাজ শুরু করবেন। শুরু করলেই শেষ হবে এবং দ্রুত শেষ হবে, আমরা বহুদিন পর ভোট প্রয়োগ করে একটি নির্বাচিত সরকারের মুখ দেখতে পারবো।
লেখক: কলামিস্ট
সূত্র: সাপ্তাহিক একতা