ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ

শিক্ষার্থীদের মহান বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটল। আপাত নিরীহ আন্দোলন ছিল এটি। কিন্তু যথাসময়ে যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে না পারায় তা পল্লবিত হয়। এক পর্যায়ে যৌক্তিক সমাধানের পথে না হেঁটে বলপ্রয়োগে দমনের স্বৈরাচারী পদ্ধতি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারি বাহিনী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছেলেদের সশস্ত্র আক্রমণে অনেক প্রাণ ঝরে যায়। আহতের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়তে থাকে। এভাবে বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে একটি সাধারণ আন্দোলন অসাধারণ গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। তাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসন। একনায়কতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের যেভাবে পতন ঘটার কথা সেভাবেই পতন ঘটেছে।

একটি নায়কোচিত শাসনের বিপরীতে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এমন পরিবর্তনের পর যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আগুনে অনেক কিছু প্রজ্বলিত হতে পারে সেই প্রস্তুতি ছিল না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো নৈরাজ্য সামাল দেওয়ার চেষ্টা করবে কিন্তু তার আগেই অনেক কিছু ক্ষতি হয়ে গেছে এবং আশঙ্কা করছি আরও ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।

স্থানীয় নৈরাজ্য ঠেকাতে প্রথম প্রয়োজন পুলিশ বাহিনী। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন এক রকম ভেঙে গেছে এ দেশে। আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং সবশেষে গুলি চালানো এসব বেশি করতে হয়েছে পুলিশকে। এ কারণে আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ হয়ে পড়ে পুলিশ। সময়-সুযোগে পুলিশও আক্রান্ত হতে থাকে। আন্দোলনকারী হোক বা তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়া সন্ত্রাসীদের হাতে হোক অনেক পুলিশও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এভাবে পুলিশ ও আন্দোলনকারীরা একে অন্যের শত্রুপক্ষ হয়ে পড়ে। পাঁচ আগস্ট ছোট্ট ভাষণে সেনাবাহিনী প্রধান সরকারের পতনের তথ্য ও শিগগিরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা জানিয়ে বলেছিলেন এখন থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ সার্বিক শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পুলিশি দায়িত্ব সেনাবাহিনীর পক্ষে পালন করা কঠিন। তাই তারা নৈরাজ্য থামাতে পারেনি। পত্রিকার তথ্যমতে, এর পরও ত্রিশ থেকে চল্লিশটি থানা দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দেয়। অতঃপর দেশের মাঠ পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা গ্রামগঞ্জে নানা জায়গায় আক্রমণ চালাতে থাকে। আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী, সমর্থকদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হতে থাকে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়। কোথাও কোথাও হামলা চলে সংখ্যালঘু মানুষদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। কোথাও কোথাও মন্দির আক্রান্ত হয়। লুটপাটের ঘটনা ঘটে অনেক জায়গায়। কিন্তু এসব ঠেকাতে কার্যত আমরা সফল হতে পারিনি।

গৌরবময় একটি বিপ্লবের পর এমন অবস্থা অনেক দেশেই দেখা গেছে। কিন্তু আমরা সতর্ক তৎপরতা দেখাতে পারিনি। পৃথিবীজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ভারতীয় নানা চ্যানেলে হিন্দু নিগ্রহের প্রচারণা অনেকগুণ বেশি করে দেখানো হচ্ছে। আমি আমার পরিচিত ছয় হিন্দু বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। দেশের ছয় জায়গায় তাদের অবস্থান। হিন্দু বাড়ি ও মন্দির আক্রান্ত হওয়ার কথা তারা শুনেছেন কিন্তু তাদের এলাকায় কিছু হয়নি। শুধু একজন জানিয়েছেন, তার বোনের গ্রামে কিছু দুর্বৃত্তের হামলা হয়েছে। চাতাল থেকে ধান লুট করেছে। কলকাতা থেকে আমার ছাত্রস্থানীয় এক হিন্দু বন্ধু আতঙ্কিত হয়ে ফোন করেছিলেন। জানালেন তাদের ওখানে গুজব ছড়াচ্ছে এবং মন্দির পোড়ানো ও হিন্দু বাড়ি, দোকান লুটের ভিডিও দেখিয়ে ভয়ঙ্করভাবে প্রচার করা হচ্ছে। এর কতটুকু বাস্তব তা জানতেই ফোন করা। ছেলেটি আইটি বিশেষজ্ঞ এবং মানুষ হিসেবে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের। সে জানাল পরীক্ষা করে দেখেছে এর অনেক ভিডিওই সাজানো এবং একই ছবি নানাভাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব উসকে দেওয়া হচ্ছে।

৭ জুলাই বিএনপির সমাবেশ থেকে নেতারা দলীয় কর্মী-সমর্থকদের দায়িত্ব দিয়েছেন সংখ্যালঘুসহ অন্যদের নিরাপত্তা বিধান করতে। জনরব আছে দেশজুড়ে এমন প্রতিশোধপরায়ণতা দেখাচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের নানা সংগঠনের নেতাকর্মীরা। যদি তা হয় তা হলে দলীয় নেতাকর্মীরা কি দলীয় আদেশ পালন করবে! গত ৭ আগস্ট টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে একজন জ্যেষ্ঠ দায়িত্বশীল সুপরিচিত সাবেক সামরিক কর্মকর্তা একটি আতঙ্কের কথা জানালেন। বিএনপি নেতাদের এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। বললেন ছাত্রদল-যুবদলের ছেলেদের আচরণে মনে হচ্ছে এখন দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপি এসে গেছে। অন্তত ওয়ার্মআপ হচ্ছে সেভাবেই। ঢাকা শহরেই তার এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে শুনেছেন এখনই ছাত্রদল ও যুবদলের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে তারেক জিয়া দেশে ফিরবেন সে কারণে টাকা লাগবে। শুনে আমার স্মরণে পড়ল কিছুকাল আগে ঢাকা শহর থেকে শুরু করে সাভারেও একটি আতঙ্ক ছিল। শাহাদত নামে মিরপুরের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী নাকি জেলে আটক। তাকে বের করে আনতে অনেক টাকা প্রয়োজন। তাই সন্ত্রাসীর দোসররা টেলিফোন করে চাঁদা দাবি করত। আমার এক সহকর্মীকেও ফোন করেছিল এক লাখ টাকা না দিলে তার স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে তুলে নেওয়া হবে। এই নিরীহ অধ্যাপক নাকি কিছু টাকা দিয়ে রফাও করেছিলেন। ৮ আগস্টের পত্রিকায় দেখলাম ছাত্রদল পরিচয়ে চাঁদা চাইতে গিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চাঁদাবাজ আটক হয়েছে। তাকে ছাড়াতে স্থানীয় বিএনপি নেতা এলে তাকেও ধরে বেঁধে রেখেছে ছাত্ররা।

মানুষ বলাবলি করছে চাঁদা চাইতে হবে কেন বিএনপি ছেলেদের। পল্টনের জনসভায় যে বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক জমায়েত হয়েছিল প্রত্যেকে নেতার জন্য পাঁচ টাকা করে দিলেই তো টাকায় ভেসে যাবে। সাধারণ মানুষের কাছে হাত পাততে হবে না।

এসব খুব খারাপ ইঙ্গিত। আমি প্রথমত মনে করি এবারের গণবিপ্লব প্রত্যক্ষ করে সবাই অনুধাবন করবেন এত সহজ হবে না ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ হওয়া। কিন্তু এই মুহূর্তে তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। বিএনপি নেতারা আহ্বান জানিয়েছেন। আশা করি কঠোরভাবে নির্দেশও দেবেন নেতাকর্মীদের, যাতে এরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটায়। অনেক পক্ষ আছে এই সুযোগে বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে চাইবে। কারণ পুলিশ প্রশাসন ভেঙে পড়ার সুযোগে অনেক রাহাজানি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা হচ্ছে। আগুন দেওয়া হচ্ছে। লুটপাট হচ্ছে। অনেককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়ার অপরাধে হিন্দু বাড়ি ও মন্দির আক্রান্ত হচ্ছে। এসবের জন্য প্রায় ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবিরের চেয়ে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নামটিই সামনে চলে আসছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার কারণে নানা জায়গায় ডাকাতির কথা শোনা যাচ্ছে। বলা হয় এই সুযোগটি নিচ্ছে মাদকাসক্ত ও টোকাই শ্রেণির ছেলেরা বেশি। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একাধিক ডাকাতির কথা শুনেছি। আমার বাড়ি সাভারের জামসিং মৌজায়। এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন অবনতি দেখিনি। আমার এলাকায় তিন বছর বসবাস করছি। এতদিনে ছোট চুরির কথাও শুনিনি। গত বুধবার রাত দুইটায় ঘুম ভেঙে গেল মাইকিংয়ের শব্দে। মসজিদের মাইকে সবাইকে সজাগ থাকতে বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এলাকায় ডাকাত পড়েছে। সকালে জানলাম একদল ছেলে মাঝরাতে এক বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করছে। মাইকের আওয়াজে ও লোকজনের শোরগোলে পালিয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে পরিস্থিতির সুযোগে নানা এলাকায় অবাধে ঢুকে পড়ছে মাদক।

এসব বাস্তবতায় এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আশা করি পুলিশ প্রশাসন পুনর্গঠন করে দ্রুত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এগিয়ে চলার জন্য আশু দায়িত্বগুলোও পালন করতে হবে। প্রত্যাশা করি সবার সহযোগিতায় সরকার সফল হবে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়