বাবুল চন্দ্র সূত্রধর
আন্দোলন প্রত্যয়টিকে সাধারণত ধ্বংসাত্মক, আক্রমণাত্মক কিংবা মারমুখী কর্মপ্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে কোন কোন আন্দোলন ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করে এটি অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এক্ষেত্রে আন্দোলনের শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা খুবই জরুরী। সকল আন্দোলন একই চরিত্র নিয়ে আবির্ভুত হয় না। অর্থনৈতিক সংস্কার আন্দোলন বলতে গেলে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে নানা উন্নত জাতিতে লক্ষ্য করা যায়। এরা সর্বদাই গবেষণা পরিচালনা করে কিভাবে আর্থিক নীতিমালা প্রণয়ন করলে রাষ্ট্রে আরোও সমৃদ্ধি আসতে পারে। সমাজে প্রচলিত রীতিনীতির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। চলমান কোন্ প্রথা মানুষের উপকারের পরিবর্তে অপকার সাধন করছে এবং কোন্ প্রথার প্রচলন ঘটাতে পারলে সমাজের অধিকতর উপকার সাধিত হতে পারে, তা সকল সমাজেরই গবেষণার বিষয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, সাহিত্য তথা জ্ঞানী ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনাপ্রসূত দলিলও আন্দোলনেরই এক একটি প্রকাশ। তার মানে, আন্দোলন হল প্রচলিত বা চলমান কোন রীতি বা আইনের পরিবর্তন অথবা পরিবর্তিত কোন নীতি বা আইনের সংশোধন প্রত্যাশা করে জনমত সৃষ্টি করে মানানসই রীতি বা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কর্মকা- পরিচালনা করা। কোন বিশেষ ইস্যুতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের কাছে দাবী উত্থাপন করাও সামাজিক আন্দোলনের পর্যায়ভুক্ত। যা হোক, আমাদের আজকের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে, যদিও রাজনৈতিক আন্দোলন এই আলোচনায় একেবারেই অবিচ্ছেদ্য।
সামাজিক আন্দোলন সমাজবিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্যয়। অনেক সমাজবিজ্ঞানী এই প্রত্যয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন। সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁত (১৭৮৯-১৮৫৭) যুক্তিনির্ভর সামাজিক স্থিতি (social statics) ও সামাজিক গতি (social dynamics)-র যে তত্ত্ব প্রদান করেন, তাতে সামাজিক আন্দোলনের সুস্পষ্ট উপস্থিতি রয়েছে। সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩)-এর ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (historical and dialectical materialism) তত্ত্বটি সামাজিক আন্দোলনের ধারায়ই প্রণীত, যা তাঁর নানা তাত্ত্বিক আলোচনায় লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক আন্দোলনের ধরন-প্রকৃতি এতই বিচিত্র যে একে শ্রেণীবিন্যস্ত করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তাই বিভিন্ন সমাজাবিজ্ঞানী স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গীতে সামাজিক আন্দোলনের শ্রেণীকরণ করেছেন। আমরা এখানে তুলে ধরব সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড এভারলী প্রদত্ত শ্রেণীকরণটি। তাঁর মতে, সামাজিক আন্দোলনের চারটি শ্রেণী রয়েছে; যথা- পরিবর্তনমূলক, সংস্কারমূলক, পুনরুদ্ধারমূলক ও বিকল্প আন্দোলন। তবে বলা যায়, সামাজিক আন্দোলন একেবারে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠ্য নিয়ে পরিচালিত হতে পারে না, মাঝে মাঝে তা মিশ্র রূপ ধারণ করতে দেখা যায়।
সামাজিক আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো দাবী আদায়ের প্রচেষ্টা। দাবী আদায় হওয়ার পর এটি আর চলমান থাকে না। তাই সামাজিক আন্দোলন সর্বদাই সুম্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। সামাজিক আন্দোলনের কিছু বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে: যেমন,
সামাজিক আন্দোলন সাধারণত কোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে উদ্ভূত হয় না;
এটি সর্বদাই স্বত:স্ফূর্ততায় পরিপূর্ণ থাকে;
এটি আন্দোলনকারীদের বিবেক, অভিজ্ঞতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সৃষ্ট;
মানুষের চাহিদার অপূর্ণতাপ্রসূত অসন্তোষ থেকে এর উৎপত্তি হয়ে থাকে;
এটি কোন পক্ষের উত্থান বা পতনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয় না;
উদ্দেশ্য বা দাবী পূরণ হওয়ার পর এর কোন কার্যকারিতা থাকে না;
সামাজিক আন্দোলন কোন ভাবাবেগগত আদর্শ নিয়ে চলে না, এটি সম্পূর্ণই আন্দোলনকারীদের দাবীর ওপর নির্ভরশীল;
সামাজিক আন্দোলনে সাধারণত অহিংস চরিত্র বজায় থাকে;
কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয় বরং সমাজের সকলের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সামাজিক আন্দোলন রচনা করা হয়;
রাজনৈতিক আন্দোলনের মত নেতৃত্ব এখানে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, এখানে ব্যক্তিপূজার স্থান নেই;
সামাজিক আন্দোলনের দাবীর মূল উপজীব্য কোন পরিবর্তনের লক্ষ্যে অথবা পরিবর্তন প্রতিরোধের লক্ষ্যে;
সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তন নয় বরং ক্রিয়াগত পরিবর্তনে এটি সক্রিয়; ইত্যাদি।
অপরদিকে, সুনির্দিষ্ঠ দর্শন বা আদর্শ, সুনিয়ন্ত্রিত নীতিমালা, নির্বাচিত বা মনোনীত নেতৃত্ব, স্থায়ী কার্যালয়, সুপরিকল্পিত কর্মপ্রক্রিয়া ও সুসংগঠিত কর্মীবাহিনী সম্বলিত রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্য ও কর্মসূচী বাহ্যত ইস্যুভিত্তিক হলেও এসবের পেছনে থাকে ভিন্ন উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, রাজনৈতিক আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি যাই হোক, এর আসল উদ্দেশ্য ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতার পালাবদল ঘটানো- ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই এর উৎপত্তি, বিকাশ ও বিনাশ। ক্ষমতাকেন্দ্রীক বলেই এখানে সহিংসতা ও আক্রমণাত্মক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন উভয় ক্ষেত্রেই জনমতের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও সামাজিক আন্দোলনের সাথে ক্ষমতার কোন সম্পর্ক নেই। মানব সভ্যতার সূতিকাগার বলে স্বীকৃত ১৭৮৯-র ফরাসী বিপ্লব, বৃটিশ আমলে ভারত-বাংলায় সংঘটিত কৃষক ও প্রজা বিদ্রোহসমূহ, পাকিস্তান আমলে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন ও ১৯৬২-র ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশের ১৯৯২-র গণআদালত ও ২০১৫-র গণজাগরণ মঞ্চ প্রভৃতি সামাজিক আন্দোলনের এক একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
অতি সাম্প্রতিককালে (জুলাই, ২০২৪) বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলন সামাজিক আন্দোলনেরই এক সুস্পষ্ট প্রকাশ, যেটি সরকারী চাকুরী প্রদানের ক্ষেত্রে অনুসৃত কোটার বণ্টনব্যবস্থা নিয়ে ছাত্রদের অসন্তোষের ফলে সংঘটিত হয়। প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীই যেহেতু চাকুরীপ্রার্থী তাই তারা এরূপ আন্দোলন করবে, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তাদের এই দাবী যুক্তিপূর্ণ নাকি যুক্তিহীন সে বিচারে না গিয়েও একে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যেকোন নাগরিকের/ নাগরিক সমষ্টির অধিকারের চর্চা বলতে কারো কোন আপত্তি বা দ্বিধা নেই, থাকার কথাও নয়। তাদের এই আন্দোলনের সূচনা ঘটে সামাজিক আন্দোলনের বর্ণিত বেশিষ্ঠ্যগুলো নিয়েই। তারপর হঠাৎ এক অশুভ সময়ে এই আন্দোলন পেয়ে যায় রাজনৈতিক চরিত্র। শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ এবং পরিসমাপ্তিতে বহু মায়ের সম্ভাবনাময় সন্তানের অতিশয় দু:খজনক চিরবিদায়!
এই অনাকাঙ্খিত ঘটনার উৎপত্তি থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত আনুপুঙ্খ অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরী। দেশের প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহ থেকে শুরু করে রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি তথা ব্যাঙ্ক, শিল্প ও বাণিজ্য, মানবাধিকার, সামাজিক উন্নয়নভিত্তিক গবেষণা, ধর্ম ও নৈতিকতা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ, তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, বিষ্ফোরক ও জ্বালানি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ নিয়ে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যেটি পুরো ঘটনার বাস্তব চিত্র জনসমক্ষে প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরবে; আর, এই প্রতিবেদনই ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে যথাযথ ঈঙ্গিত প্রদান করতে পারে। প্রচার মাধ্যমসমূহের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক ঘটনার ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ এক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। ছাত্রদের এই দাবী ও দাবীভিত্তিক আন্দোলনকে কোনভাবেই রাজনীতির মানদন্ডে বিচার করা যাবে না; বরং সামাজিক আন্দোলন হিসেবে একে সমাজ কাঠামোয় বিরাজমান সংশ্লিষ্ট উপাদানসমূহের নিরীখে বস্তুনিষ্টভাবে বিবেচনা করাটা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হবে, ফলদায়ক হবে বলে আমরা মনে করি। সমাজবিজ্ঞানীরা এসব বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণে সামাজিক মনস্তত্ত্বের ওপরই সবিশেষ জোর দিয়ে থাকেন।
গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী ও গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে যেকোন সময়ই সামাজিক আন্দোলন সংঘটিত হতে পারে; তবে সামাজিক আন্দোলন যেন এর চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য থেকে বিচ্যূত হতে না পারে, সেজন্যই এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করা হয়েছে। দেশের সাধারণ নাগরিকরা সর্বদাই একটি শান্তিপূর্ণ ও যুক্তিশীল সমাজ ব্যবস্থা আশা করে। যার যার দাবী উত্থাপন করুক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, যেখানে কোন অশান্তির উৎপাদন হবে না, ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হবে না; জনগণের স্বাভাবিক জীবনচর্যায় যেন কোনরূপ বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।
লেখক:
বাবুল চন্দ্র সূত্রধর, মানবাধিকার কর্মী ও গবেষক