বিশ্বের বাছাইকৃত ১১টি দেশের কৃষকদের জনপ্রতি গড় ভর্তুকি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বৈশ্বিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশন এইড। ফান্ড ফর ফিউচার শীর্ষক এ প্রতিবেদনে তিনিট মহাদেশের (এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা) ১১টি দেশের ভর্তুকির তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশগুলোর সরকার কৃষিতে যে ভর্তুকি দিয়েছে তার জনপ্রতি তথ্য বের করা হয়েছে।

সেই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একজন কৃষককে চীন সরকার বছরে প্রায় ১৫৯ ডলার ভর্তুকি দিচ্ছে। এশিয়ার অন্যতম কৃষি উৎপাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়ার কৃষক পাচ্ছে প্রায় ৯৩ ডলার। সেখানে সর্বনিম্ন প্রদানের তালিকায় রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের মালাউই ও সেনেগাল। দেশ দুটিতে জনপ্রতি ভর্তুকি পায় যথাক্রমে ৪.৮ ডলার ও ৭.২ ডলার।

এর ঠিক আগের অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে জনপ্রতি ভর্তুকি পাচ্ছে মাত্র ৭.৮ ডলার। ফলে ওই সময়ের মুদ্রা বিনিময় হার ১০০ টাকা হিসেবে নিলে জনপ্রতি কৃষক পাচ্ছেন মাত্র ৭৮০ টাকা।

অর্থমন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত তিন অর্থ বছরে ধারাবাহিকভাবেই কমানো হচ্ছে কৃষিতে ভর্তুকি। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কৃষিতে ভর্তুকি ছিল ২৫ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা, যা গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে নেমে আসে ২৪ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা।

যদিও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা গত অর্থ বছরের তুলনায় সাত হাজার ৭১ কোটি টাকা কম। ফলে বাজেট কমানো হয়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।

যদিও বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্তই দেওয়া হয় দেশের ভর্তুকি কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি কমানোর শর্ত রাখা হয়। এ ছাড়া নানা সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঋণদাতা সংস্থাগুলো থেকে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ ও চাপ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় কৃষিতে ভর্তুকি কমানো হলে সার্বিক উৎপাদনব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন খাত বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রয়োজন অনুসারে দেশের কৃষকদের ভর্তুকি দিতে পারছি না। আবার কৃষি উপকরণের বাড়তি দামকে যদি বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে প্রকৃতপক্ষে ভর্তুকি আরো কমে যাবে। সার্বিকভাবে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হলে কৃষি জিডিপির মোট ১০ শতাংশ ভর্তুকি দিতে হবে। যেটি এখন ৩ শতাংশের নিচে রয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘নানা কারণে দেশে কৃষি উপকরণ খরচ বাড়ছে। এ অবস্থায় ভর্তুকি না দিলে কৃষকের উপকরণ খরচ আরো বেড়ে যাবে। ফলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে, যা  মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে। মনে রাখতে হবে, বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উৎপাদন কমার শঙ্কায় আছি আমরা। এ অবস্থায় আমাদের শস্য আমদানিনির্ভরতায় না গিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোয় নজর দিতে হবে। সে জন্য কৃষকের ভর্তুকি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্যশস্যের চাহিদা ও উৎপাদনের তথ্যে নানা ধরনের অসংগতি রয়েছে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে উপকরণসংকট, মাঠ পর্যায়ে অদক্ষতা, প্রযুক্তির অভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভাবনা পরিপূর্ণ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চাল বাদে ১১টি খাদ্য ও কৃষি পণ্যের আমদানি হয়েছে প্রায় ৮৭ লাখ ১২ হাজার টন।

আর আমদানিনির্ভরতার কারণে ডলারসংকট আরো কঠিন হচ্ছে। ফলে ফসল উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানোয় প্রণোদনা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে। কৃষি উপকরণ বিশেষ করে সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি খাতে আর্থিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।

সূত্র: কালের কন্ঠ