সংবাদ বিজ্ঞপ্তি।। আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ ২৯) -এর প্রাক্বালে ৫-১১ নভেম্বর সমগ্র এশিয়া মহাদেশব্যাপী গ্যাস সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হচ্ছে, যার অংশ হিসেবে এশিয়ার ১০ টি দেশের নদী ও সমুদ্রে শত শত মাছ ধরার নৌকা জীবাশ্ম গ্যাস সম্প্রসারণ বন্ধের দাবিতে নৌ-যাত্রা আয়োজন করছে।
আজ ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানে নৌকা বিক্ষোভ আয়োজিত হয়, যার মাধ্যমে জীবাশ্ম গ্যাসে বিনিয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয় যা ফিলিপাইনের আটটি উপকূলীয় এলাকায় আগামী ১১ নভেম্বর, ২০২৪, কপ-২৯ শুরুর দিন একই ধরনের কর্মসূচির মধ্যদিয়ে শেষ হবে।
এশিয়ার পাশাপাশি আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকায়ও একই দাবীতে আন্দোলন ও কর্মসূচী সংগঠিত হচ্ছে। এ অঞ্চলের যেসকল দেশ বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দ্বারা পরিচালিত গ্যাস শিল্প সম্প্রসারণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবিকার প্রতীক মাছ ধরার নৌকা নিয়ে গ্যাস এবং এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
এশিয়া ডেস অব অ্যাকশন উপলক্ষে এশিয়ান পিপলস মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এপিএমডিডি)-এর সমন্বয়কারী লিডি ন্যাকপিল বলেন, "আমরা কপ ২৯-এর আগে বিশ্ব নেতাদের প্রতি এই শক্তিশালী আহ্বান জানাচ্ছি। জীবাশ্ম গ্যাসে ক্রমাগত বিনিয়োগ আমাদের পরিবেশ ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং কপ ২৮-এর জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগের অঙ্গীকারকে সমুন্নত রাখা উচিত। আমরা বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানাই যেন তারা জীবাশ্ম গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাবকে অগ্রাহ্য না করে, জলবায়ু তহবিল প্রদানে ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।"
তিনি আরও বলেন, "সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলো, বিশেষত কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান, জীবাশ্ম গ্যাস প্রকল্পগুলিতে ১৪২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থায়ন করছে। জীবাশ্ম গ্যাসের ওপর নির্ভরতা পরিহার করে সৌর ও বায়ু শক্তির মতো পরিচ্ছন্ন শক্তির ব্যবহারই আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পথ।"
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেছেন, "এশিয়ায় জীবাশ্ম গ্যাসের সম্প্রসারণ বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং প্যারিস চুক্তির অধীনে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধির সীমা অর্জনের সম্ভাবনাকে নষ্ট করছে। গ্যাস অবকাঠামোতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার অর্থ হলো এশিয়াসহ পুরো অঞ্চলকে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন, অপরিবর্তনীয় অবকাঠামোর বিস্তার এবং বাড়তে থাকা জলবায়ু ঝুঁকি আব্যাহত রাখা। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের চরম প্রতিকূল প্রভাবের শিকার; জনস্বাস্থ্য, জীবিকা এবং জনগণের বাস্তুচ্যুতি ক্রমাগত বাড়ছে, যার দীর্ঘমেয়াদী মূল্য পরবর্তী প্রজন্মকে বহন করতে হবে।”
বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ বাংলাদেশের ১০ জেলার ১৫টি নদীতে পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি, নদী রক্ষার আহ্বান এবং গ্যাসের বিস্তার বন্ধ করার দাবীতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এ কর্মসূচিটি এশিয়ান পিপলস মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এপিএমডিডি), ডোন্ট গ্যাস এশিয়া, এশিয়া এনার্জি নেটওয়ার্ক (এইএন), ডোন্ট গ্যাস সাউথ, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, পশুর রিভার ওয়াটারকিপার, সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার, খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার, সুন্দরবন রক্ষায় আমরা, নিরাপদ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, হাওর রক্ষায় আমরা, কুতুবদিয়া দ্বীপ সুরক্ষা আন্দোলন (কেডিএসএ), আমরা কলাপাড়াবাসী, পায়রা নদী ইলিশ রক্ষা কমিটি, পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন, লতাকাটা জেলে সমবায় সমিতি, লালুয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি, পেকুয়া উপকূল মৎস্যজীবী সমিতি, উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশন এবং মহেশখালী জন-সুরক্ষা মঞ্চ-সহ অন্যান্য স্থানীয় সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোর মধ্যে ছিল ঢাকা জেলার মিরপুরে তুরাগ নদী, নারায়ণগঞ্জ জেলার মেঘনা ঘাটে মেঘনা নদী; কক্সবাজার জেলার পেকুয়ার মগনামা-কুতুবদিয়া চ্যানেল, কুতুবদিয়ার পাইলটকাটা খাল, মহেশখালীর কোহেলিয়া নদী; বরগুনা জেলার বরগুনা সদর উপজেলার খাগদন নদী, পাথরঘাটার বলেশ্বর নদী, তালতলীর পায়রা নদী; পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদী; বাগেরহাট জেলার মংলার পশুর নদী; হবিগঞ্জ জেলার হবিগঞ্জ সদর উপজেলার খোয়াই নদী, নবীগঞ্জের বিজনা নদী; সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটের রাতারগুল জলারবন; জামালপুর জেলার যমুনা নদী এবং ময়মনসিংহ জেলার ব্রহ্মপুত্র নদী।
'গ্লোবাল ডেস অফ অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট গ্যাস এক্সপ্যানশন' কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী জলবায়ু অধিকার কর্মীরা "গ্যাস সম্প্রসারণ বন্ধ কর", "প্রাকৃতিক গ্যাস এবং এলএনজি প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ কর", "গ্যাস নয়, সমাধান হলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি", "জীবাশ্ম গ্যাস পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর", "জীবাশ্ম গ্যাস মানুষের জন্য বিষাক্ত", "জীবাশ্ম গ্যাস একটি ব্যয়বহুল জ্বালানি", "বাংলাদেশে গ্যাস সম্প্রসারণ করা চলবে না" "গ্যাস কোনো ট্রানজিশন জ্বালানি নয়, সরাসরি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে হবে"-ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড ধারণ করেন। এসময় তারা নিম্নলিখিত দাবিগুলো উত্থাপন করেছেন:
১) নতুন কোনো জীবাশ্ম জ্বালানির প্রকল্প বা আর্থিক সহায়তা নয়, সরকারি বা বেসরকারি – নতুন অনুমোদন, লাইসেন্স, পারমিট, বা সম্প্রসারণ বাতিল করতে হবে। এই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত এবং যুক্তিসঙ্গত জলবায়ু তহবিল প্রদান করতে হবে।
২) ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির সীমা রক্ষায় দ্রুত, ন্যায্য এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে বিদ্যমান জীবাশ্ম জ্বালানি অবকাঠামো পর্যায়ক্রমে বন্ধের লক্ষ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি চুক্তিসহ বিশ্বব্যাপী একটি কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
৩) প্রতিটি দেশ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী যাতে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে জলবায়ু অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৪) কার্বন অফসেট, কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ (সিসিএস) বা জিওইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি জলবায়ু সংকটের প্রকৃত সমাধান নয়। তাই এ সমস্ত ভ্রান্ত সমাধান বন্ধ করতে হবে।
৫) জীবাশ্ম জ্বালানি-সৃষ্ট ক্ষতির জন্য দায়ীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৬) জলবায়ু কার্যক্রমে কর্পোরেট প্রভাব বন্ধ করতে হবে এবং কর্পোরেট স্বার্থের প্রভাবমুক্ত জলবায়ু আলোচনার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।